অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায় মিয়ানমার। এর আগে দুইবার ফেরত নেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হলেও তাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। তাই প্রশ্ন উঠেছে এবার সফল হবে কী না। আর এটা মিয়ানমারের নতুন কোনো ফাঁদ নয় তো?
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত। তা থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিক বলে নিশ্চিত করেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “মিয়ানমার প্রথম দফায় ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায়। কিন্তু আমরা চাই এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে প্রথম দফায় ফেরত নেওয়া হোক। এটা হলে একই পরিবারের সবাই যেতে পারবেন। তা না হলে পরিবারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে।”
শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, “এ সংক্রান্ত কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আমরা পাইনি। আমরা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি। ফলে আমাদের দিক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।”
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। এর আগে আরও দুইবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসেন।
শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছি। ওরা তাদের পরিচিতি পরীক্ষা করছে, যদি সত্যি বলে থাকে। তারা ২৯ হাজারের পরিচিতি এখন পর্যন্ত নিশ্চিতের কথা বললেও আমাদের কাছে কোনো তালিকা পাঠায়নি।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা এক হাজার ১০০ জনকে ফেরত পাঠাতে চাই এটা মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বললেন তা আমার জানা নেই। আর মিয়ানমার যে ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় তাও অফিসিয়ালি আমরা জানি না।”
তবে মিয়ানমার যদি এখন ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন এটা মিয়ানমারের একটি ফাঁদ বা নতুন কোনো চাল হতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক সামরিক অ্যাটর্নি মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, “একটি রোড ম্যাপ ছাড়া ৭০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। আগে মিয়ানমার নিশ্চিত করবে যে সর্বমোট কত জনকে তারা কতদিনে ফেরত নেবে। নয়তো তারা এই ৭০০ জনকে ফেরত নিয়ে বলবে আমরা তো ফেরত নিয়েছি। আর নেবে না।”
তিনি বলেন, “১৯৯৩ সালে তারা একই কাজ করেছিলো। কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে আর নেয়নি। ২০১১ সালে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয় মিয়ানমারকে। তখন তারা মাত্র ছয় হাজারকে রোহিঙ্গা বলে মেনে নেয়। তারা আসলে টোকেন হিসেবে কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে চায় আর কিছু নয়।”
তার মতে, “ইউক্রেনে রাশিয়ারা হামলার পর ইউরোপে এখন শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে। ইউরোপের নজর এখন ওদিকে। এই সুযোগকে মিয়ানমার কাজে লাগাতে চায়।”
তার কথা রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন যেখানে তৃতীয় পক্ষ থাকবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, “মিয়ানমার যে চীনের কথায় ওঠবস করে তা ঠিক নয়। তারা তো ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের বিপক্ষে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গিয়ে ভোট দিয়েছে। তারা এখন প্রমাণ করতে চায় যে মিয়ানমারে গণহত্যা হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতকেও এটা বোঝাতে চায়। তাই তারা কিছু রোহিঙ্গাকে এখন মিয়ানমারে ফেরত নিতে চায়। কিন্তু সব রোহিঙ্গাকে কবে ফেরত নেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
তার মতে, “বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি দেখতে হবে। আগে মিয়ানমারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে হবে তারা কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে। তারপর এটার রোড ম্যাপ করতে হবে। তারাতো ঠিক করে বলছেই না যে কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে। যদি এটা নিশ্চিত না হয় তাহলে দেখা যাবে হাজার খানেক নিয়ে আর নেবে না। তাদের যা উদ্দেশ্য তা কিন্তু তারা করে নেবে।”
এদিকে তথ্য উপাত্ত বলছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ দিন দিন কমে আসছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্লান-এর যে হিসাব তাতে দেখা যায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মোট ডোনারদের সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দিয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম। ২৬৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া যায়নি।
এর আগেও কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে প্রয়োজন ছিলো ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার, পাওয়া গেছে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার।
এখানে স্পষ্ট যে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তাও কমছে এবং প্রতিশ্রুত সহায়তার গড়ে ৭০ ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ইউক্রেনে হামলার পর শনিবার পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৩০ লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে।
এই দুই বিশ্লেষক মনে করেন, “ইউরোপে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি তাদের মনোযোগ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। আর এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে মিয়ানমার। তাই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন ফোরামে আরও শক্ত অবস্থানে গিয়ে কথা বলতে হবে।” সুত্র: ডয়চে ভেলে
পাঠকের মতামত